লোকালাইজেশন” বা স্থানীয়করণ আজকের জীবনধারায় কতখানি প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিক?

আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আপনার বিপনণের সামগ্রী জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রাথমিক শর্তের মধ্যেই পড়ে। বিভিন্ন ভাষার মানুষের কাছে তাঁদের নিজস্ব ভাষায় সেই সামগ্রী হাতে তুলে দেওয়া সেই বিশেষ জিনিসের গ্রহণযোগ্যতা শতগুণে বাড়িয়ে দেয়।

“নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান”, ১৯৩১ সালে প্রকাশিত অতুলপ্রসাদের এই গান আজকের লোকালাইজেশনের যুগে বোধহয় সার্থকভাবে উচ্চারণ করা যায়। এমন এক পৃথিবীতে আমরা থাকি যেখানে ৫০০০-এর বেশি ভাষাভাষি মানুষ বসবাস করেন। অধিকাংশ ভাষারই আছে নিজস্ব লিপি, ব্যাকরণ। এমন বহু ভাষাভাষি মানুষ আছেন, যাঁরা কেবলমাত্র একটি গণ্ডীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন ভৌগলিক দূরত্বসহ নানাবিধ কারণে। কারণ দীর্ঘসময় জুড়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ রেখে যাওয়া ছিল ব্যয়বহুল এবং একই সঙ্গে জটিল শ্রমসাধ্য। কিন্তু উড়োজাহাজ ও টেলিকমিউনিকেশনের বিপ্লব গোটা বিশ্বকে একীভূত করেছে বা বলা ভালো হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।

শূন্য দশকদ্বয়ে (২০০০-২০১৮) এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ইন্টারনেটের ব্যবহার চমকপ্রদভাবে ১০০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মানে হল, এই সময়কালে বহুল সম্ভাব্য গ্রাহকের সংখ্যাও সমহারে বেড়েছে। বিশ্ববাজারের প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে, অন্তর্জালে জড়িত এই বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বায়নের দ্বার ব্যপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। অবশ্য, এই বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা বড় অংশই এখনও ইংরেজি নয়, মাতৃভাষায় যোগাযোগ করতে বেশি স্বচ্ছন্দ। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, প্রদীপের তলায় অন্ধকার এখনও একইরকম রয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো প্রতিদিন তাদের বিপননের ক্ষেত্রে এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গ্রাহকদের অনেকেরই ইংরেজির প্রাথমিক জ্ঞান আছে। বিশেষ করে যে দেশগুলি দীর্ঘদিন ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। এই সব দেশ বা গ্রাহক বাজারের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে যে, সেখানে পণ্য ও পরিষেবা বিষয়ক কন্টেন্টগুলি স্থানীয় ভাষায় প্রকাশ করা হবে নাকি ইংরেজিতেই রেখে দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই সহজ হয় না, পাশাপাশি ভাষা পরিবর্তনের সঙ্গে রাজস্ব উশুল, ব্র্যান্ডের ইমেজ এবং তার বিপননের পদ্ধতির কথাও মাথায় রাখতে হয়। আবার, পণ্য ও পরিষেবার বিবরণ ইংরেজিতে রেখে দেওয়াও একদিক থেকে সুবিধাজনক। সেক্ষেত্রে, সেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মূল বক্তব্য, তার ধরণ ধারণ একই থাকবে, লোকালাইজারের প্রয়োজন হবে না। যদিও আমরা এখানে ঠিক উল্টো কথাই বলব যে ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বা বলা ভালো, সমাজ ও সময়ের বিভিন্ন স্তরে ব্যবসার সামগ্রী পৌঁছে দিতে লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণ কতখানি প্রাসঙ্গিক আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে।

গ্রাহকরা নিজেদের মাতৃভাষায় কতখানি স্বচ্ছন্দ?

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পণ্য সামগ্রীর বিবরণ ও UI (ইউজার ইন্টারফেস) মাতৃভাষায় পেলে গ্রাহকরা সহজেই সেদিকে আকৃষ্ট হন। সেই সামগ্রী কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অবশ্য এটাও দেখা গেছে যে, সস্তা নয়, দামি জিনিস কেনার ক্ষেত্রে, মাতৃভাষায় বিবরণ পেলে গ্রাহকরা বেশি খুশি হন। সস্তা জিনিসের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ফ্যাক্টর ততটা কাজ করে না। কারণ সহজেই অনুমান করা যায় যে, দামি জিনিসের দীর্ঘ বিবরণ মাতৃভাষায় বুঝে নেওয়া যতটা সহজ, ইংরেজিতে বুঝে ওঠা সবসময় ততখানি সহজ নাও হতে পারে। ইতালির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা করা হয়, তাদের দুটি সামগ্রীর মধ্যে থেকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। একটিতে সামগ্রীর বিবরণ ছিল ইংরেজিতে এবং অপরটিতে ছিল ইতালীয় ভাষায়। ছাত্রছাত্রীদের মূল ঝোঁক কিন্তু ইতালীয় ভাষায় লেখা বিবরণের সামগ্রীর দিকেই দেখা গেছে। মজার ব্যপার হল, এই ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু প্রায় সবাই ইংরেজি ভাষায় বেশ দক্ষ। এর পাশাপাশি, স্থানীয় ভাষার ব্যবহার গ্রাহকদের শ্রেণিকরণ করতে সাহায্য করে। তাদের ব্যবহারগত দিক থেকেই হোক বা পছন্দগত বা প্রবৃত্তিগত, বলা ভালো, স্থানীয় ভাষার ব্যবহার গ্রাহক চিনে নিতে অনুঘটকের কাজ করে।

গ্যালোপ-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ মানুষ মাতৃভাষায় অনলাইন ওয়েবসাইট সার্চ এবং কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। তার মানে, গ্রাহকদের লক্ষ্যমাত্রার একটা বড় অংশ নিজেদের ভাষা ব্যবহার করতেই স্বচ্ছন্দ। এই বিষয়ে আরও জানার জন্য, মালেশিয়ায় একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিমা কেনার ক্ষেত্রে বা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মানুষজন স্থানীয় ভাষার প্রচারাভিযানে বেশি সাড়া দিচ্ছেন।

স্থানীয় ভাষা আর কি করতে পারে?

কোন সামগ্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষায় সেই সামগ্রীর প্রচার বহুক্ষেত্রেই ম্যাজিকের মতো কাজ করে। গ্রাহকের সেই সামগ্রীকে অনেক বেশি অাপন মনে হয়। ব্র্যান্ডের ইমেজ তৈরি করতে এবং সেটি ধরে রাখতে স্থানীয় ভাষায় প্রচার অনেকটাই রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা দেয়।

এর পাশাপাশি, ওপরে যে সমীক্ষাগুলির কথা বলা হল, তার ফলাফল থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, গ্রাহকের গ্রহণযোগ্যতার উপরে স্থানীয় ভাষায় প্রচার অনুঘটকের মতো কাজ করে যার সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সংশ্লিষ্ট সংস্থার লভ্যাংশের ওপর। তাই যেসমস্ত বহুজাতিক সংস্থা প্রকৃত অর্থেই বিশ্বায়িত হতে চায় তাদের অবশ্যই লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণের আশ্রয় নিতে হবে। নাহলে গ্রাহকদের একটা বড় অংশ অধরা থেকে যাবে। বর্তমানে অনেক বহুজাতিক সংস্থাই এই বিষয়টি উপলব্ধি করে স্থানীয় ভাষায় তাদের সামগ্রীর প্রচারে মনোযোগী হয়েছে। যার ফলে, বলা যেতে পারে যে, বিশ্ব স্থানীয়করণ শিল্পোদ্যোগ হল এমন একটি ক্ষেত্র যা এই বিশ্বব্যাপী মন্দার বাজারেও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে।

কি ভাবছেন? সবাই এগিয়ে চলেছে লোকালাইজেশনের মাধ্যমে ব্যবসাকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। আর আপনি?

দ্রষ্টব্য:

[1] https://www.internetworldstats.com/stats.htm

[2] Can’t Read, Won’t Buy: Why Language Matters on Global Websites By Donald A. DePalma, Benjamin B. Sargent, and Renato S. Beninatto September 2006

[3] Cross-Cultural Consumer Behavior: Use of Local Language for Market Communication—A Study in Region Friuli Venezia Giulia (Italy) by Franco Rosa, Sandro Sillani & Michela Vasciaveo
Pages 621-648 | Journal of Food Products Marketing Volume 23, 2017 – Issue 6

[4] User language preferences online; Survey conducted by The Gallup Organization, Hungary upon the request of Directorate-General Information Society and Media

[5] The Influence of Language of Advertising on Customer Patronage Intention: Testing Moderation Effects of Race Muhammad Sabbir Rahman, Fadi Abdel Muniem Abdel Fattah, 1 2
Nuraihan Mat Daud and Osman Mohamad ; Middle-East Journal of Scientific Research 20 (Language for Communication and Learning): 67-74, 2014

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *