” এলেম নতুন দেশে–
তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে॥
অচিন মনের ভাষা শোনাবে অপূর্ব কোন্ আশা,
বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল,
বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল–
নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে॥
নাম-না-জানা প্রিয়া
নাম-না-জানা ফুলের মালা নিয়া হিয়ায় দেবে হিয়া।
যৌবনেরি নবোচ্ছ্বাসে ফাগুন মাসে
বাজবে নূপুর বনের ঘাসে।
মাতবে দখিনবায় মঞ্জরিত লবঙ্গলতায়
চঞ্চলিত এলো কেশে॥”
“তাসের দেশ”-এ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নতুন দেশে এসে রাজপুত্র ও সওদাগরপুত্র নব উচ্ছ্বাসের প্রকাশে মেতেছিল এভাবেই। অচিন মনের ভাষা, নাম না জানা প্রিয়া, নাম না জানা ফুলের মায়া হিয়ায় যে দোলা দেয়, তার খোঁজেই তো ভেসে যাওয়া জীবনভর… অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা।
এক বিখ্যাত অবাঙালী লেখক একবার খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জীবনে একটা খুব বড়ো দুঃখ থাকবে যে রবীন্দ্রনাথকে বাংলা ভাষায় পড়তে বা অনুভব করতে পারলাম না। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানাকে দ্বিতীয় সত্ত্বার অধিকারী, দ্বিতীয় আত্মার অধিকারী হওয়ার মতো মনে করতেন রোমান সম্রাট চার্লস দ্য গ্রেট। বিখ্যাত লেখক জিওফ্রে উইলিয়ানসের একটি বিখ্যাত উক্তি এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে, তাঁর মতে, একটি ভাষাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে গেলে অপর একটি ভাষা জানা খুব জরুরি। একটি ভাষা জ্ঞানের পূর্ণতার মাধ্যমেই আরেকটি ভাষাকে অনুভব করা যায়। পাশাপাশি, কোনও নির্দিষ্ট ভাষার সাহিত্য, শিল্পকর্ম অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য সেটিকে মূল ভাষায় পড়া জরুরি। মূল কবিতা বা সাহিত্যের ভাব কেবলমাত্র সেই ভাষার ছত্রে ছত্রেই আস্বাদন করা যায় স্বার্থকভাবে।
স্নায়ুগত প্রভাব
গবেষক ডঃ ভিয়োরিকা মারিয়ান এবং অ্যান্থনি শিউক গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, কোনও নতুন ভাষা শিক্ষা, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা, একাগ্রতা, একসঙ্গে একাধিক কাজ করার দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। তার কারণ, আমরা অন্য কোনও ভাষায় যত কথাই বলি না কেন, মাথায় সেগুলো ভাবার সময় মাতৃভাষাতেই চিন্তা করি। এই বিষয়টি এতই নিরন্তর ঘটে যে আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি সজাগ হয়ে যায়। মস্তিষ্কের এই সক্রিয়তা খুব ছোট শিশুদের মধ্যেও দেখা যায়। গবেষকরা বলে থাকেন, শিশু যদি বহুভাষী কোনও পরিবারে বেড়ে ওঠে, তাহলে সেই শিশুর মস্কিষ্কের কর্মক্ষমতা গড়পড়তা শিশুর চাইতে বেশি হবে। তবে যদি এটা মনে করা ঠিক নয় যে, নতুন ভাষা শুধুমাত্র ছোটবেলাতেই শেখা সম্ভব। শেখার ক্ষেত্রে বয়স কোনওদিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, তথাকথিত “সিনিয়র সিটিজেন”রাও নতুন ভাষা অনায়াসে শিখে ফেলছেন। এমনকি এটাও দেখা গেছে যে, একাধিক ভাষা জানা মানুষের স্মৃতিশক্তি অনেক বেশি ভালো তাদের তুলনায় যাঁরা মাত্র একটি ভাষা জানেন।
সামাজিক জীবন
আমরা যত নতুন ভাষা শিখি, তত ভালো দুটি ভাষার মধ্যে অনুবাদের সেতুবন্ধন করতে পারি। দুটি ভাষার মধ্যে এই সেতু গড়ে তোলা আমাদের সামগ্রিক কমিউনিকেশন স্কিল বাড়িয়ে তুলতে, যৌক্তিক এবং বৌদ্ধিক ভাবনাগত ক্ষমতা আরও পরিণত করতে সাহায্য করে। যার ফলে, আমরা নিজেকে এবং আশেপাশের মানুষকে আরও ভালোভাবে বুঝতে, ভাবের আদান প্রদান করতে পারি বা বলা ভালো নিজেকে অন্যের কাছে আরও বেশি করে প্রকাশ করতে পারি। মজার ব্যাপার হল, কোনও কোনও ভাষায় এমন অনেক শব্দ আছে যার উপযুক্ত প্রতিশব্দ অন্য ভাষায় পাওয়া যায় না। যেমন, ঊর্দূ শব্দ “রুহ”, বাংলা বা হিন্দীতে রুহ-কে সার্থকভাবে ধরা সম্ভব নয়। রুহ এমন এক অতীন্দ্রিয় আত্মিক প্রকাশের প্রতিরূপ যাকে সার্থকভাবে অন্য কোন প্রতিশব্দের মাধ্যমে তুলে ধরা অসম্ভব। ফলে, সেই বিশেষ অনুভূতি বা অনুভবের প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট শব্দটিকে অবিকৃতভাবে নিজের ভাষায় তুলে আনা ছাড়া উপায় থাকে না। এটাকে ঠিক ভাষা বিজ্ঞান বা ভাষার বিবর্তনের পর্যায়ে ফেলা ঠিক হবে না। বরং ভাষাগত আদানপ্রদান অনেক বেশি প্রযোজ্য হবে। এই পারস্পরিক আদান প্রদান আখেরে ভাষার ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করে। অন্যভাষার চোরাস্রোত ঢুকে পরে অপর এক ভাষার মধ্যে আর ক্রমে সেই ভাষারই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়, হয়ে যায় সেই বিশেষ ভাব প্রকাশের আধার।
কাজের সুযোগ
জীবনপঞ্জীতে দুই বা তার বেশি ভাষায় দক্ষতার কথা লেখা থাকলে তা চাকরীক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে বাকিদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে দেবে। পাশাপাশি, যতগুলো ভাষা জানা থাকবে ঠিক ততগুলো ভাষায় কাজের সুযোগও আসবে। স্থানীয়করণের ক্ষেত্র তো বটেই, বাকি অনেক ক্ষেত্রেও একাধিক ভাষায় দক্ষতা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে।
উদাহরণ ১
হসপিটালিটি/ পর্যটন: এই ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় এমন মানুষজনের সঙ্গে কাজ করতে হয় যেখানে হয় গ্রাহকরা স্থানীয় ভাষা জানেন না বা অনেকে আবার হিন্দী ইংরেজির মতো সাধারণের কথ্য ভাষাও জানেন না, তাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের মাতৃভাষাতেই স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে, গ্রাহকের মাতৃভাষায় কথা বললে গ্রাহকেরা অনেক বেশি আপন অনুভব করবেন এবং কাজের ক্ষেত্রে আপনার কদরও বাড়বে।
উদাহরণ ২
সাংবাদিকতা: ধরা যাক আপনি যে সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করেন তারা আপনাকে দেশের বাইরে কোনও জায়গার নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে পাঠালো বা ধরুন আপনি ভারতের মতো বহুভাষী দেশে আপনার নিজের রাজ্যের বাইরে অন্য কোনও রাজ্যে সংবাদদাতা হিসেবে নিযুক্ত। সেক্ষেত্রে আপনি যদি সংশ্লিষ্ট জায়গার ভাষা জেনে থাকেন তাহলে স্বভাবতই আপনার কাজ অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। সংবাদিকতায় একটি কথা চালু আছে যে, কোনও নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বললে অনেক বেশি স্বতস্ফূর্ত জবাব পাওয়া যায়। সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে যা খুবই প্রয়োজন।
নতুন ভাষা শেখার বিষয়ে আপনি কি আমাদের সঙ্গে একমত? আপনি কি এই বিষয়ে আরও কিছু বলতে চান? তাহলে মন্তব্য করে আমাদের জানান। আমরা শুনতে চাই…
December 24, 2018 — magnon