কবিতার পথে “কথা ছিল যাত্রী হওয়ার”

ধরা যাক সময়টা মোবাইল যুগের আগে। বাড়ির লোক মেনে না নেওয়ায় নিজেরাই লাল নীল সংসার সাজানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে অনিন্দ্য আর শ্যামাশ্রী। ঠিক দুপুর ১২টায় শোভাবাজার মেট্রো গেটে দেখা করার কথা। সেই মতো, দুপুর ঠিক পৌনে ১২টায় দুরুদুরু বুকে শোভাবাজার মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়েছিল শ্যামাশ্রী। ১৫ মিনিট গেল, আধঘন্টা গেল, একঘণ্টা… চোখের কোণটা সবে ভিজে ভিজে উঠছে। কি হল অনিন্দ্যর, তাহলে কি ও আসবে না… সবটাই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি… তারপর আরও একটা ঘন্টা গেল। দিশেহারা হয়ে তখন মেট্রোর সিঁড়িতে বসে পড়েছে শ্যামাশ্রী। আরও একঘন্টা… বুকের তোলপাড় সামলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ৭৮ নম্বর বাস ধরে বাড়ির পথ ধরে সে। আর ওদিকে ততক্ষণে ২ প্যাকেট সিগারেট নিঃশেষ করে মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ শোভাবাজার মেট্রোর গেটে বসে আছে অনিন্দ্য। ভাবছে শেষপর্যন্ত শ্যামা পারল না, পারল না সব বাধা সরিয়ে, সাহস দেখিয়ে তার হাত ধরতে। অবাক লাগছে? হ্যাঁ, ওরা দুজনেই এসেছিল, শোভাবাজার মেট্রোয়, গেট দুটো ছিল আলাদা, ল্যান্ডফোনের সতর্ক ক্ষণিক বার্তায় গেট নম্বরটা আর মিলিয়ে দেখা হয়নি দুজনের। তাই হয়ত আর যাত্রী হওয়া হল না অনিন্দ্য ও শ্যামাশ্রীর, কথা দিয়েও…
Written by: Pamela B

আসলে “সমস্ত কথা কে রাখিতে পারে বলো আর”… তাই হয়ত পিয়াল ভট্টাচার্য তাঁর নতুন বইটির নাম রেখেছেন “কথা ছিল যাত্রী হওয়ার”। 

“অদূরে আলোর রং গতিবিধি রেখা টেনে দিলে/ সব চাওয়া জমে ওঠে ওয়েটিং রুমটিকে ঘিরে”, ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিষাদবিধুর প্ল্যাটফর্মের কাছে শুধু থেকে যায় ট্রেনের ছুঁয়ে থাকার স্মৃতি। সেটুকু সম্বল করেই তার সব চাওয়া জমে ওঠে ওয়েটিং রুমকে কেন্দ্র করে, যা আসলে অপেক্ষারই নামান্তর। তাই হয়ত ট্রেন তার ছেড়ে যাওয়া নিয়তিকে মেনে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে হলদে আলো জ্বলে ওঠা ওয়েটিং রুম থেকে যেন ভেসে আসে, “মেরা কুছ সামান, তুমহারে পাস পড়া হ্যায়…”

বইটির সূচিপত্রই যেন কবিতার দ্যোতনা হয়ে ধরা দেয়। “গোধূলি”… যেন শেষের হাত ধরে নতুন শুরুর দিকে হাঁটা,আবছায়া… অধরা মাধুরীকে ধরার অদম্য ইচ্ছেটা… বিলাসখানি টোড়ি…. চিরবিচ্ছেদের আবেগে কম্পিত বেসুরো সেই অদ্ভুত সুর, কাটাকুটি… ছকবাঁধা গোল্লাছুটের টানাপোড়েনে বিদ্ধ কথার ছোঁয়া… ডায়েরি…বা ধরা যাক ওয়োটিং রুম…সবটুকু অপেক্ষা ছায়া ফেলে পথের পানে চেয়ে থাকে যেখানে। এ যেন ঠিক বেদনার ব্যালাড নয় বরং সেই বিধুরতাকে আলিঙ্গনের আকুলতা। তাই হয়ত কবি বলে ওঠেন, পথ চলা বিচ্ছেদ মেশে বিষণ্ণতারসুখে ধাবমান ট্রেন, দৃশ্যের সরে যাওয়া.. যেন সবটুকু মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রেমের পথে.. কারণ বিচ্ছেদ যেমন সত্যি তেমনই তো সত্যি প্রেম…তাই হয়ত কবি সহযাত্রীর মুখে প্রেমের ছায়া ফেলার আগে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখেন।

আসলে সেই ফাঁকা অবসরটুকুই তো মুখোমুখি হওয়ার সময় যেখানে ভুলে থাকবার অভ্যাস আমাদের সঙ্গী হয় একা ও কয়েকজনকে নিয়ে। কারণ আবেগ তো আসলে কানামাছি খেলা নিজেরই সঙ্গে…তাই তো গুলিয়ে যায় সানাই আর সে নাই…অদৃশ্য অশ্বমেধের ঘোড়ায় বসে জিতে নিতে চাওয়া সবকটা হেরে যাওয়া খেলা।

সব খেলা ফুরিয়ে যাওয়ার পর যেই ঘোর কাটে স্বপ্নের, ওমনি নিজেরই বিষণ্ণমুখ ধরা দেয় নিরালা দুপুরে, সামাজিক ঘেরাটোপে আবদ্ধ জীবনের সকাতরে কেঁপে ওঠা অনুভূতি যেন বিলাসখানের সেই বেদনার দ্যোতক হয়ে বাজে। সেই বেদনা আড়াল করতে আবার ফিরে আসতে হয় স্মৃতির কাছে কখনও বা ক্ষতদাগের কাছে কারণ হয়ত সেখানেই লুকানো আছে বিগত স্মৃতির সুখ। শীতের মতো জড়িয়ে থাকা ঘোরে তোমার কাছেই তো নিরাময় খুঁজে নিতে আসি প্রতিবার।

কিন্তু তোমার কাছে তো সে আসা ছিল সহজিয়া আর আমার কাছে সময় বিভ্রম, তাই তো নিয়ন্ত্রিত আত্মসংযমে দমবন্ধ হয়ে অবচেতনে আত্মগোপন করে অনুভূতি। তবুও তো জাগে মেলানোর আকুলতা… প্রতিনিয়ত বিদ্ধ হবার সুরে, এই তো আসলে জীবনের নামান্তর… তাই না… যেখানে নিজের মনকে দমবন্ধ করেও ফের সেই অসম্ভবের আশাকে কেন্দ্র করে জমিয়ে তোলে ভালবাসার সঞ্চয়। যেখানে জীবনকে হাতছানি দেয় অলীক সমুদ্দুর আর বাকিটা… বাকিটা তো আসলে অলীক প্রলেপ, অন্ধ আলোয় গাঁথা।

পিয়ালের পুরো বইটিই আসলে আলো আধাঁরির এক গাঁথামালা, দুপুরের তপ্ত নিঃশ্বাসের মত সঘন ভালবাসার স্মৃতিচিহ্ন…সেটুকুই তো থাকে জীবনের শেষে… সমস্ত পথ পার হয়ে এসে কোনও এক নির্জন কোণে নিজের পাশে বসে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় অনুরাগ নামক এক প্রগাঢ়তাকে… সমর্পণের কাঙ্খায় আলোড়িত অভিমান…এক উদাসীন অলীকযাপন, জীবনের ওপর পলাতকা ছায়া ফেলে যায়। সেই ছায়ায় ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ফের যেন পরিত্যক্ত হল্ট স্টেশনে বেজে ওঠে ট্রেনের হুইসল…হলদে আলোয় ভাসতে থাকে ওয়েটিং রুম, সবটুকু পিছনে ফেলে পা বাড়াই সহযাত্রী হওয়ার পথে… আমার যে “কথা ছিল যাত্রী হওয়ার”…

——————————————————————————————————————————-

Book : Katha Chhilo Yatri Hoar

Writer: Piyal Bhattacharya

Disclaimer : The opinions expressed here belong solely to the author(s) and are not to be taken as the stated position(s) of Magnon or its subsidiaries.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *